![]() |
| আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? – ডা জাকির নায়েক (What is the puepose of our life? – Dr Jakir Nayak) |
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও গুণগান একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও প্রতিপালক সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যিনি ব্যতীত প্রকৃত সত্য কোন ইলাহ নেই। অজস্র সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (স), তার সহধর্মিণী ও সাহাবীগণের ওপর।
মূল লেকচারের নাম "What is the puepose of our life" বা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? বিষয়ে দেয়া ডা. জাকির নায়েকের এ বক্তব্যটি বর্তমানে উদ্দেশ্যহীন জীবন পরিচালনায় অভ্যস্থ মুসলিমদের অবস্থান বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য বক্তব্যের মতো তার এ বক্তব্যেও যেমন রয়েছে হৃদয়স্পর্শী উদ্দীপনা তেমনি রয়েছে চলার পথের সঠিক পাথেয় ও প্রেরণা। কারণ, উদ্দেহীন জীবন আর হাল বিহীন নৌকার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছা দূরহ-ই শুধু নয়; অসম্ভবও বটে।
মানুষকে মহান আল্লাহ তায়ালা কোনো উদ্দেশ্য ব্যতীত সৃষ্টি করেন নি। নিশ্চয়ই মানব সৃষ্টির একটি উদ্দেশ্য রয়েছে।
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون .
অর্থ : আমি জ্বীন এবং মানুষকে এই কারণে সৃষ্টি করেছি, যাতে তারা আমার ইবাদত করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানুষ তার জীবনকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পরিচালনা করতে পারে না। বক্ষমান লেকচারে ডা. জাকির নায়েক পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আলোচনা করেছেন।
একটি কথা সবারই জানা দরকার যে, লিখিত বক্ততা ব্যতীত অন্যান্য সাধারণ বক্ততার ক্ষেত্রে বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রায় কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এ ধরণের বক্ততা প্রসঙ্গ খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হয়।
যাহোক এ বইয়ের আলোচিত বক্তব্যটিকে বিষয়ানুপাতে সহজেই বোঝার সুবিধার্থে ছোট-বড় অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুবাদ কর্ম আসলেই কঠিন একটি কাজ। তারপরও বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণের নিকট ডা. জাকির নায়েকের লেকচার তুলে। ধরতে ক্ষুদ্র এ প্রয়াসে ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে সহৃদয় পাঠকমহলের পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। আপনাদের দু'আ কামনায়।
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। - ডা. জাকির নায়েক
الش على رسول الله وعلى أله الحثيثه. وال وأصحابه أجمعين . أما بعد. أعود بالله من الشيطاني الرجيم . بسم الله الرحمن الرحيم . وما خلقت الجن والإنس الايثون . ....... ربي اشرح لي صدري و لي آثرى واحلل عقدة ممن لساني يفقهوا قولى.
উচ্চারন: আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহি ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাইন। আম্মাবাদ। আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিআ'বুদুন। আল্লাযি খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আহসানু আমালা। রব্বিশ রাহলি সাদরি ওয়া ইয়াসসিরলী আমরী ওয়াহলুল উকদাতাম মিনলীসানী ইয়াফকাহু কাউলী।
শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞগণ, বক্তাগণ, শ্রদ্ধেয় অতিথিবৃন্দ, শ্রদ্ধেয় গুরুজনেরা, প্রিয় ভাই ও বোনেরা এবং সেই লাখ লাখ দর্শক, যারা টিভিতে এই অনুষ্ঠান দেখছেনআপনাদের স্বাগত জানাই ইসলামিক সম্ভাষণে, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আল্লাহ তায়ালার দয়া, শান্তি এবং রহমত আপনাদের সবার ওপরে বর্ষিত হোক।
আজকে আমাদের ১০ দিনব্যাপী কনফারেন্সের শেষ দিনে আমি আপনাদের সামনে শেষ লেকচারটা দিচ্ছি।
আজকের লেকচারের টপিক হলো- আমাদের তথা মানুষের এই জীবনের উদ্দেশ্যটা কী?
আমাদের মধ্যে কতজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করেছেন যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী। আমাদের মধ্যে কজন আছেন, যারা চিন্তা-ভাবনা করেছেন এ ব্যাপারে যে, আমাদের এই অস্তিত্বের উদ্দেশ্যটা কী। আমরা এখানে কী করছি? এখানে কেন এসেছি? আসুন, আমরা এই ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে দেখি।ক’জন লোক জীবনের উদ্দেশ্য জানে?
আমি দর্শকদের অনুরোধে করবো, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি কখনও একটা চিন্তা করে থাকেন যে, আপনার জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? তাহলে দয়া করে হাত | তুলুন। আমি জানতে চাচ্ছি যে, এখানে দর্শকদের মাঝে ক’জন এটা নিয়ে চিন্তা। করেছেন যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, | ১৫/২০ জন হাত তুলেছেন; খুব বেশি হলে ১০০জন হাত উঠিয়েছেন। এখানে প্রায় ১ লাখ মানুষ আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী- এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার লোকসংখ্যা ০.১ শতাংশেরও কম। অনেকেই হয়তো হাত তুলতে লজ্জা পেয়েছেন, আর তাই হাত তুলেননি। তারপরও আমরা বলতে পারি যে, মানুষের মধ্যে ০.১ শতাংকের কম মানুষ এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী?এখন কথা হল- আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? এটা জানা কি খুব জরুরি? আমি আপনাদের একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আর সেটা হল- মনে করুন একটি লোক হাঁটতে হাঁটতে এক মোড়ে আসলো। তখন সে অন্য আরেক জনকে | জিজ্ঞাসা করলো “এই রাস্তাটা কোন দিকে গিয়েছে, ভাই?” পথিক তাকে বলল| “আপনি কোথায় যেতে চান?" লোকটি বলল- “যে কোনো জায়গায়।” তখন | পথিক বলবে- “যে কোনো পথে যান কোনো সমস্যা হবে না।"
এখানে এই লোকটার কোনো উদ্দেশ্য নেই। লোকটা যেসব কাজ করে, তার সেই কাজগুলো কোনো রকম পার্থক্য সৃষ্টি করে না; কারণ তার কোনো গন্তব্য নেই। আমাদের মধ্যে অনেকে ঠিক এভাবেই জীবন-যাপন করছে।
একবার এক লোক তার প্রতিবেশীকে বলল- “আপনার কুকুরটা সবসময় | গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে। ভাবছি এই কুকুরটা কখনও কি কোনো গাড়িকে ধরতে পারবে?” প্রতিবেশী উত্তর দিল- “কোনো গাড়িকে ধরতে পারবে কি না। সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না, বরং আমি ভাবছি গাড়িটা ধরতে পারলে সে তখন কী করবে।” যে লোকটা বলছে, কুকুর গাড়িটা ধরতে পারবে কি না সে কিন্তু বুঝতে পারছে না। আর প্রতিবেশী, যে কুকুরটার মালিক; সে কিন্তু বুঝতে পারছে যে, কুকুর যদি গাড়িটাকে ধরতে পারে তারপর সে কী করবে; সে বুঝতে পারছে | যে, এখানে কুকুরটার উদ্দেশ্যটা কী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অনেকেই আমাদের জীবনটাকে এইভাবে পার করে দিচ্ছি; এই কুকুরটার মতোই।
একবার এক লোক গ্রাম থেকে মুম্বাইতে চলে আসলে বড়লোক হওয়ার জন্য। তাকে একবার প্রশ্ন করা হল- “আপনি মুম্বাইতে আসলেন কেন?" সে তখন বলল- “আমি হিন্দি সিনেমায় দেখেছি অমিতাভ বচ্চনকে, সে খুব গরিব ছিল, তারপর মুম্বাইতে এসে একরাতের মধ্যে অনেক বড়লোক হয়ে গেল। এই জন্য আপনারা প্রায়ই দেখবেন, মুম্বাইয়ে আশেপাশের বহু এলাকা থেকে মুম্বাইতে চলে। আসে, যাতে একরাতে বড়লোক হতে পারে। এই কারণে আমরা দেখতে পাই মুম্বাইতে বস্তির সংখ্যাও খুব দ্রুত বাড়ছে।
অনেক সময় আপনারা দেখবেন, অভিনেতা আর মডেলরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়। | তারা বিভিন্ন পণ্যের মার্কেটিং করে। একবার আমার পরিচিত একজন একটা নতুন গাড়ি কিনলো হুন্দাই আইটেমের। তাকে জিজ্ঞেস করা হল- “আপনি হুন্দাই আইটেমের গাড়ি পছন্দ করলেন কেন?” সে বলল- “আমার প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান; আর তার একটা হুন্দাই গাড়ি আছে; এজন্য আমি এই হুন্দাই আইটেম গাড়ি পছন্দ করেছি।”
আমি জানি না, অভিনেতা শাহরুখ খান ওই হুন্দাই আইটেম গাড়িতে একদিন ছাড়া আর কোনো দিন বসেছেন কিনা। সে চালায় মার্সিডিজ অথবা বিআইডাব্লিউ অথবা এরকম কিছু। আমার সন্দেহ তার আসলে হুন্দাই আইটেম আছে কি-না।
শাহরুক খান মডেল হয়েছেন ট্যাগ হিয়ার ঘড়ির। সেটা বিখ্যাত ঘড়ি, সন্দেহ নেই। এখন শাহরুখ খানের অনেক ভক্তই ট্যাগ হিয়ার ঘড়ি ব্যবহার করছে। আমি জানি না শাহরুখ খানের অভিনয়ের সাথে এই ট্যাগ হিয়ারের সম্পর্কটা কী। ট্যাগের এই ঘড়িটা তাকে কি অভিনয় করতে সাহায্য করেছে? আমার তো মনে হয় শাহরুখ খান বিখ্যাত হওয়ার আগে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখেননি বা ব্যবহার করেননি।
এরকম বিভিন্ন মিডিয়ায় পণ্যের মার্কেটিং করা হয়; আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অন্য মানুষকে নকল করার চেষ্টা করি। আর সেটা বেশিরভাগ সময় কিছু না বুঝেই করি।
তারপর ধরুন, আর একজন লোক, যার কোনো উদ্দেশ্য আছে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে- “পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী হওয়া।” এজন্য সে কী করল? সে প্রথম মানব আদম (আ) থেকে শুরু বর্তমান সময় পর্যন্ত সব ইতিহাস পড়ল। সে সবকিছু পড়ে জানতে পারলো যে, পৃথিবীর মধ্যে এ পর্যন্ত অতিবাহিত সময়ের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন। আর এ কথাটি সঠিক। এটা জানার পর লোকটা কী করলো? সে আইজ্যাক নিউটনের মতো হওয়ার জন্য মাথার চুল লম্বা রাখলো। অর্থাৎ আইজ্যাক নিউটনের মতো বাবরি । তারপর নিউটনের মতো করে সে জামাকাপড় পড়তে শুরু করল। সেই লোক কি নিউটনের মতো বিজ্ঞানী হতে পারবে? এই লোকের একটি উদ্দেশ্য আছে, কিন্তু তার প্ল্যানিংটা ভুল। একটি প্ল্যান অবশ্য তার ঠিক যে, সে বিজ্ঞানীদের নিয়ে পড়াশুনা করেছে। তবে তার পুরো প্ল্যানিংটা ভুল।
এই প্রশ্নটার সবচেয়ে সেরা উত্তর যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবেন আমাদের স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া। তায়ালা। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই উত্তর দিতে পারবেন যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী।
আমার লেকচারের শুরুতে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছিলাম। সেটা হচ্ছে সূরা যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াত । সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون .
অর্থ ; আমি জ্বীন এবং মানুষকে এই কারণে সৃষ্টি করেছি, যাতে তারা আমার ইবাদত করে। (সূরা যারিয়াত : আয়াত-৫৬)
আমি জ্বীন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য। এখানে যে আরবি শব্দটি আছে সেটা । (ইবাদাহ)। এর মূল আরবি শব্দ ২ (আবদ)। যার অর্থ ভৃত্য অথবা দাস। -। (ইবাদাহ) অর্থ- সেবা করা, আনুগত্য করা, অনুগত হয়ে আত্মসমর্পণ করা। এককথায় ইবাদাহ মানে উপাসনা করা।
অথবা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশগুলো মেনে চলা, ঈশ্বরের নির্দেশগুলো মেনে চলা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে যে কাজগুলো করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো যদি মেনে চলি, তাহলে সেটাই হবে ইবাদাহ, সেটাই হবে উপাসনা।
যেমন ধরুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, তোমরা পাঁচটি স্তম্ভ মেনে চলবে। যদি আপনি তাওহীদে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তাহলে ইবাদত করছেন, আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি আপনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন, তাহলেও আপনি ইবাদত করছেন, আল্লাহ তায়ালার উপাসনা করছেন। যদি আপনি যাকাত দেন; যেটা বাধ্যতামূলক; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন।
যদি সিয়াম পালন করেন, তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের সাহায্য করো। যেটা বলা হয়েছে সূরা মাউনে। এটা করলেও আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা হবে।
যদি আপনি সেই কাজগুলো থেকে বিরত থাকেন, যা করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিষেধ করেছেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি শুকরের মাংস না খান; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি চুরি করা, প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। এককথায় আপনি যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশগুলো মেনে চলেন, আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত করছেন।
জীবনের উদ্দেশ্যের রকমফের
আপনাদের আরো একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন একজন বিন্ডার (স্থপতি) একটি বিল্ডিং বানানো শুরু করল । বিল্ডিংয়ের ভিত তৈরির জন্য সে মাটিতে বড় একটি গর্ত তৈরি করল। এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হল- “আপনার এই বিন্ডিংটা কত তলা পর্যন্ত হবে?সে বলল- “আমি জানি না।” প্রশ্ন করা হল “বিল্ডিংটা কত স্কয়ার ফিট জুড়ে তৈরি করা হচ্ছে?" সে বললা- “এটা নিয়ে। | চিন্তাই করিনি।” আসলে সেই বিল্ডারের কোনো উদ্দেশ্যই নেই। |একবার এক লোক তার প্রতিবেশীকে বলল- “আপনার কুকুরটা সবসময় | গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে। ভাবছি এই কুকুরটা কখনও কি কোনো গাড়িকে ধরতে পারবে?” প্রতিবেশী উত্তর দিল- “কোনো গাড়িকে ধরতে পারবে কি না। সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না, বরং আমি ভাবছি গাড়িটা ধরতে পারলে সে তখন কী করবে।” যে লোকটা বলছে, কুকুর গাড়িটা ধরতে পারবে কি না সে কিন্তু বুঝতে পারছে না। আর প্রতিবেশী, যে কুকুরটার মালিক; সে কিন্তু বুঝতে পারছে যে, কুকুর যদি গাড়িটাকে ধরতে পারে তারপর সে কী করবে; সে বুঝতে পারছে | যে, এখানে কুকুরটার উদ্দেশ্যটা কী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অনেকেই আমাদের জীবনটাকে এইভাবে পার করে দিচ্ছি; এই কুকুরটার মতোই।
উদ্দেশ্যহীন জীবন।
লোকজন গ্রাজুয়েশান করে। তাদের জিজ্ঞেস করবেন, “আপনি গ্রাজুয়েশন করছেন কেন?" তারা আসলে কারণটা জানেনা। কারণ হল, এই যে তারা। গ্রাজুয়েশন করতে যায়; গ্রাজুয়েশন করে আপনি কী করবেন? সে বলল “আমি জানি না। আমাদের বেশিরভাগই জীবনটা পার করছি গন্তব্য ছাড়া লোকটার মতো অথবা কুকুরটার মতো, যে একটা গাড়িটা ধরতে পিছনে পিছনে ছুটছে | কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই।অনুকরণপ্রিয়
মানুষ আমাদের অনেকেই না বুঝেই অন্যের উদ্দেশ্যকে নকল করি । কোনো ছাত্রকে আপনি প্রশ্ন করবেন “আপনি কমার্স পড়ছেন কেন?" সে উত্তর দিবে, “কারণ আমার বন্ধুও কমার্স পড়ছে। এছাড়া আবার অনেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রী বা বিভিন্ন মডেলকে নকল করার চেষ্টা করে। অনেকেই এটা না বুঝেই করে।একবার এক লোক গ্রাম থেকে মুম্বাইতে চলে আসলে বড়লোক হওয়ার জন্য। তাকে একবার প্রশ্ন করা হল- “আপনি মুম্বাইতে আসলেন কেন?" সে তখন বলল- “আমি হিন্দি সিনেমায় দেখেছি অমিতাভ বচ্চনকে, সে খুব গরিব ছিল, তারপর মুম্বাইতে এসে একরাতের মধ্যে অনেক বড়লোক হয়ে গেল। এই জন্য আপনারা প্রায়ই দেখবেন, মুম্বাইয়ে আশেপাশের বহু এলাকা থেকে মুম্বাইতে চলে। আসে, যাতে একরাতে বড়লোক হতে পারে। এই কারণে আমরা দেখতে পাই মুম্বাইতে বস্তির সংখ্যাও খুব দ্রুত বাড়ছে।
অনেক সময় আপনারা দেখবেন, অভিনেতা আর মডেলরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়। | তারা বিভিন্ন পণ্যের মার্কেটিং করে। একবার আমার পরিচিত একজন একটা নতুন গাড়ি কিনলো হুন্দাই আইটেমের। তাকে জিজ্ঞেস করা হল- “আপনি হুন্দাই আইটেমের গাড়ি পছন্দ করলেন কেন?” সে বলল- “আমার প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান; আর তার একটা হুন্দাই গাড়ি আছে; এজন্য আমি এই হুন্দাই আইটেম গাড়ি পছন্দ করেছি।”
আমি জানি না, অভিনেতা শাহরুখ খান ওই হুন্দাই আইটেম গাড়িতে একদিন ছাড়া আর কোনো দিন বসেছেন কিনা। সে চালায় মার্সিডিজ অথবা বিআইডাব্লিউ অথবা এরকম কিছু। আমার সন্দেহ তার আসলে হুন্দাই আইটেম আছে কি-না।
শাহরুক খান মডেল হয়েছেন ট্যাগ হিয়ার ঘড়ির। সেটা বিখ্যাত ঘড়ি, সন্দেহ নেই। এখন শাহরুখ খানের অনেক ভক্তই ট্যাগ হিয়ার ঘড়ি ব্যবহার করছে। আমি জানি না শাহরুখ খানের অভিনয়ের সাথে এই ট্যাগ হিয়ারের সম্পর্কটা কী। ট্যাগের এই ঘড়িটা তাকে কি অভিনয় করতে সাহায্য করেছে? আমার তো মনে হয় শাহরুখ খান বিখ্যাত হওয়ার আগে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখেননি বা ব্যবহার করেননি।
এরকম বিভিন্ন মিডিয়ায় পণ্যের মার্কেটিং করা হয়; আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অন্য মানুষকে নকল করার চেষ্টা করি। আর সেটা বেশিরভাগ সময় কিছু না বুঝেই করি।
উদ্দেশ্যহীন কাজের পরিণতি
মনে করুন, একজন শিল্পপতি একটি টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি করল। তাকে প্রশ্ন করা হল- “আপনি এই টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি করলেন কেন?" শিল্পপতি উত্তর। দিল- “আমি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, টেক্সটাইল ব্যবসায় অনেক বেশি লাভ করা যায়।" তাকে প্রশ্ন করা হল- “আপনার কাছে কি এ ব্যাপারে ভালো কোনো রিপোর্ট আছে?" সে বলল-“না।” তাকে বলা হল- “ব্যবসা দেখাশুনার জন্য কি কাউকে ঠিক করেছেন বা সেই কোম্পানির জন্য কি কাউকে এক্সিকিউটিভ বানিয়েছেন?” সে বলল-“না।” তাকে প্রশ্ন করা হল- “আপনি এখানে কত পার্সেন্ট লাভ করতে চান?” সে বলল- “আমি জানি না। তাকে প্রশ্ন করা হল- “আপনি টেক্সটাইল পণ্য বিক্রি করবেন কোথায়?" সে বলল“আমি জানি না। আপনাদের কি মনে হয়- এই শিল্পপতি টেক্সটাইল ব্যবসায় কোনো লাভ করতে পারবে? প্রশ্নই আসে না।তারপর ধরুন, আর একজন লোক, যার কোনো উদ্দেশ্য আছে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে- “পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী হওয়া।” এজন্য সে কী করল? সে প্রথম মানব আদম (আ) থেকে শুরু বর্তমান সময় পর্যন্ত সব ইতিহাস পড়ল। সে সবকিছু পড়ে জানতে পারলো যে, পৃথিবীর মধ্যে এ পর্যন্ত অতিবাহিত সময়ের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন। আর এ কথাটি সঠিক। এটা জানার পর লোকটা কী করলো? সে আইজ্যাক নিউটনের মতো হওয়ার জন্য মাথার চুল লম্বা রাখলো। অর্থাৎ আইজ্যাক নিউটনের মতো বাবরি । তারপর নিউটনের মতো করে সে জামাকাপড় পড়তে শুরু করল। সেই লোক কি নিউটনের মতো বিজ্ঞানী হতে পারবে? এই লোকের একটি উদ্দেশ্য আছে, কিন্তু তার প্ল্যানিংটা ভুল। একটি প্ল্যান অবশ্য তার ঠিক যে, সে বিজ্ঞানীদের নিয়ে পড়াশুনা করেছে। তবে তার পুরো প্ল্যানিংটা ভুল।
আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই জীবনের উদ্দেশ্য
এবার মূল প্রশ্নে আসি যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? পৃথিবীতে এই যে, আমাদের অস্তিত্ব; এটার উদ্দেশ্যটা কী? আপনাদের কী মনে হয়? কে এই প্রশ্নটার সঠিক উত্তর দিতে পারবেন যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? কে সে? ডা. জাকির নায়েক? অবশ্যই এর উত্তর হবে, না । ডা. জাকির নায়েক এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। তাহলে কি বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে ? এখানেও উত্তর হবে, না; বিজ্ঞানীরাও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। তাহলে কি দার্শনিকরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন? এখানেই সেই একই উত্তর যে, না; দার্শনিকরাও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নন।এই প্রশ্নটার সবচেয়ে সেরা উত্তর যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবেন আমাদের স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া। তায়ালা। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই উত্তর দিতে পারবেন যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটা কী।
আমার লেকচারের শুরুতে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছিলাম। সেটা হচ্ছে সূরা যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াত । সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون .
অর্থ ; আমি জ্বীন এবং মানুষকে এই কারণে সৃষ্টি করেছি, যাতে তারা আমার ইবাদত করে। (সূরা যারিয়াত : আয়াত-৫৬)
আমি জ্বীন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য। এখানে যে আরবি শব্দটি আছে সেটা । (ইবাদাহ)। এর মূল আরবি শব্দ ২ (আবদ)। যার অর্থ ভৃত্য অথবা দাস। -। (ইবাদাহ) অর্থ- সেবা করা, আনুগত্য করা, অনুগত হয়ে আত্মসমর্পণ করা। এককথায় ইবাদাহ মানে উপাসনা করা।
অথবা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশগুলো মেনে চলা, ঈশ্বরের নির্দেশগুলো মেনে চলা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে যে কাজগুলো করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো যদি মেনে চলি, তাহলে সেটাই হবে ইবাদাহ, সেটাই হবে উপাসনা।
যেমন ধরুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, তোমরা পাঁচটি স্তম্ভ মেনে চলবে। যদি আপনি তাওহীদে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তাহলে ইবাদত করছেন, আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি আপনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন, তাহলেও আপনি ইবাদত করছেন, আল্লাহ তায়ালার উপাসনা করছেন। যদি আপনি যাকাত দেন; যেটা বাধ্যতামূলক; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন।
যদি সিয়াম পালন করেন, তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের সাহায্য করো। যেটা বলা হয়েছে সূরা মাউনে। এটা করলেও আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা হবে।
যদি আপনি সেই কাজগুলো থেকে বিরত থাকেন, যা করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিষেধ করেছেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি শুকরের মাংস না খান; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। যদি চুরি করা, প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করছেন। এককথায় আপনি যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশগুলো মেনে চলেন, আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন; তাহলেও আপনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত করছেন।

.png)